
ক্ষমতা ধরে রাখতে আওয়ামী লীগ ১০টি বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। দলটির নেতাকর্মীরা বিশ্বাস করছেন, এসব পরিকল্পনা ঠিকঠাক বাস্তবায়ন করতে পারলে টানা চতুর্থ দফায় ক্ষমতায় আসা সম্ভব।
এসব পরিকল্পনার অন্যতম হলো রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে সরব থাকা। এ ছাড়া দলীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীদের দূরত্ব দূর করা ও সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে দলে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার কাজটি যথাযথভাবে করা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশিদের সঙ্গে সম্পর্ক যে জায়গায় গেছে সেখান থেকে সম্পর্ক পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করার সুযোগ কম। এটা ধরেই নিয়েছেন তারা। ফলে নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগকে অনেক কিছুই মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু ক্ষমতার টানা ১৫ বছরে অসংখ্য সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও সাংগঠনিক শক্তিতে অনেকাংশে গরমিল ধরা পড়েছে। যে কারণে সাংগঠনিকভাবে পিছিয়ে আছে আওয়ামী লীগ।
দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করা ও ঐক্যবদ্ধ রাখাই অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বারবার দলের ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ আওয়ামী লীগকে হারাতে পারে না। তিনি বলেন, ‘সাংগঠনিক কিছু গ্যাঞ্জাম আছে সেগুলো মীমাংসা করার কাজ চলছে।’
মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গত বছরের মাঝামাঝি থেকে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে জোরালো আন্দোলন শুরু করে। ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমমনা ৩৬টি দল স্বতন্ত্রভাবে এবং জোটবদ্ধ হয়ে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হয়। বিএনপিসহ এই ৩৭ দলের আলাদা আলাদা দাবি এখন এক দফায় পরিণত হয়েছে। সেই দাবির অন্যতম সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান।
বিরোধীদের আন্দোলনের জবাবে আওয়ামী লীগও সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচন করার এক দফা ঘোষণা করেছে। দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির পাশাপাশি সংঘাতের ঘটনাও ঘটছে।
প্রায় একই সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে আসছে। তাদের কূটনৈতিক তৎপরতাও লক্ষণীয়। প্রতিবেশী ভারত এ বিষয়ে তার অবস্থান জানিয়ে বলেছে, বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে তারা কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। এর মধ্যে ভারতের সংবাদমাধ্যমেই বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যু নিয়ে খবর প্রকাশ হচ্ছে। পাশাপাশি জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশে সভা-সমাবেশের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে সরব। এর মধ্যে গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সমর্থনে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। এই ভিসানীতিকে এক ধরনের হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এরপর দেশটির প্রতিনিধিদের সফরও বেড়েছে।
চলতি বছরের শেষের দিকে কিংবা আগামী জানুয়ারির প্রথম দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। তার আগে বিদেশিদের নজিরবিহীন তৎপরতা ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির আন্দোলনে এবার টালমাটাল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের সামনে। সে কারণে আন্দোলন সামলানো ও বিদেশিদের তৎপরতা কমাতে এত দিন ভিন্নপথে হাঁটলেও এবার নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনতে নিজের দলের শক্তির দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। সভা-সমাবেশে প্রকাশ্যেই তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে, তাহলে দলটিকে হারানোর শক্তি কারও নেই।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার এ বক্তব্যের গুরুত্ব তুলে ধরে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীর বেশ কয়েকজন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দলের ব্যাপারে তেমন কোনো নির্দেশনা ছিল না দলীয় সভাপতির। এবার বারবার একই ধরনের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, সারা দেশে সুবিধাভোগী ও ত্যাগীদের নেতাকর্মীদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সুবিধাভোগী ও ত্যাগী উভয় পক্ষের রক্তাক্ত সংঘাতের ঘটনাও ঘটছে। ক্ষমতার ১৫ বছরে সর্বত্র সুবিধাভোগীদের দেখা গেলেও এখন মাঠে-ঘাটে নজরে পড়েন না তারা। মাঠ দখলে রাখার রাজনীতিতে অদৃশ্য হয়ে গেছেন সুবিধাভোগী ও সুযোগসন্ধানী নেতাকর্মীরা।
ওই নেতারা বলেন, দলের নানা দুর্বলতা চিহ্নিত করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০টি করণীয় নির্ধারণ করেছেন। এসব করণীয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করে আগামী নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনতে চান শেখ হাসিনা।
দলের সভাপতি শেখ হাসিনা গত ৬ আগস্ট তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডাকেন সারা দেশের নেতাকর্মীদের। সেদিন বিশেষ বর্ধিত সভায় সারা দেশের অন্তত ৫০ নেতার বক্তব্য শোনেন তিনি। বিভিন্ন গবেষণা ও বর্ধিত সভায় দেওয়া নেতাদের বক্তব্যের নির্যাস নিয়ে ১০টি পরিকল্পনা ঠিক করেছেন। বিভিন্ন পরামর্শক মহলও আওয়ামী লীগ সভাপতিকে এ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজে নেমে গেছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ যাচাই-বাছাই করে দেখেছেন, নির্বাচনী মাঠে দলকে শক্ত অবস্থানে থাকতে হলে এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে হলে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এসব পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, সরকার ও দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ঠেকাতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা, মসজিদ-মাদ্রাসা ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে সচেতনতামূলক বক্তব্য দেওয়া। রয়েছে, সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড ঘটা করে প্রচার করা, যেকোনো মূল্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা, দ্রব্যমূল্য সহনীয় ও স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখা, কোনোভাবেই সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে না দেওয়া, মন্ত্রী-এমপিদের লাগামহীন কথাবার্তা বন্ধ করা, বড় কয়েকজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি হতে পারেন মন্ত্রী-এমপি ও নেতা, তাদের বিচারের আওতায় আনা, সম্পর্ক টালমাটাল থাকলেও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সম্পর্কোন্নয়ন ও দলের ভেতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব-কোন্দল দূর করা ও দলকে সংঘাতমুক্ত রাখা। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের (এমপি) সম্পদ ও আয়ের উৎস জনসমক্ষে প্রকাশ করার অঙ্গীকার থাকলেও বন্ধ থাকা সেই কাজটি নির্বাচনের আগে শুরু করতে চান প্রধানমন্ত্রী।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচনের আগে একাধিক পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে কাজ করছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে সংগঠন শক্তিশালী করা, ত্যাগী নেতাকর্মী যারা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন তাদের মাঠে নামানো, সরকারের উন্নয়ন প্রচার ও মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখা এগুলো নির্বাচন পর্যন্ত বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতার ১৫ বছরে দলে সুবিধাভোগী বেড়েছে, এটা সত্যি কথা। এর ফলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নির্বাচনের আগে তা পুষিয়ে নিতে কাজ চলছে।’
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ দেশ রূপান্তরকে বলেন, দলের পুরনো ও ত্যাগী নেতাদের সম্মান দেওয়া, পদে রাখা ও মাঠে নামানোর জন্য দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন।