Uncategorized

দিশাহীন রাজনীতি ও হতাশা

দিশাহীন রাজনীতি ও হতাশা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন ইস্যুর প্রাধান্য থাকলেও, শেষ বিচারে তা দিশাহীন। ক্ষমতাসীনেরা যেমন সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে জনকল্যাণে ভূমিকা পালন ও সুশাসন কায়েম করতে পারে না, বিরোধীরাও সরকারের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে শোচনীয় রকম ব্যর্থ। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। দলটি একসময় অস্তিত্ব-সংকটে ভুগতে থাকে। ২০১৪ সালের পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের মনোবল ভেঙে যায়।

মাঠেও তেমন একটা দেখা যায়নি দলটিকে। দলের কোনো নেতাকেও সে সময় সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দণ্ডিত এবং তারেক রহমান দেশে না থাকায় নেতা-কর্মীরা ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়েন! ছোটখাটো নানা কর্মসূচি দিলেও কোনোটাই হালে পানি পায়নি; বরং বিএনপি নেতাদের ‘ঈদের পর’, ‘রোজার পর’ কর্মসূচি-সংক্রান্ত বক্তব্য নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রায়ই কটাক্ষ করেন। তবে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে চলতি বছরের শুরু থেকে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের চাঙা করতে বিভিন্ন কৌশল বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।

গত কয়েক মাসে বিভাগীয় সমাবেশ, ঢাকায় মহাসমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে দলটি আবার চাঙা হয়েছে। কিন্তু শেষ বিচারে দলটি কী চায়, কোথায় যেতে চায়, কোথায় গিয়ে থামতে চায়, তা স্পষ্ট নয়। আওয়ামী লীগ যদি শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানে, তাহলে তারা কী করবে, তা কেউ জানে না। এ অবস্থায় দলটির ব্যাপারে রয়েছে একধরনের হতাশা।

আবার ক্ষমতাসীনদের প্রতিও সাধারণ মানুষের আস্থা মোটেও প্রবল নয়। সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি, জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে মানুষ ক্ষমতাসীনদের প্রতিও বিরক্ত। কিন্তু এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কীভাবে ঘটাবে, সেটা তারা জানে না।

আসলে আমাদের দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা আছে, উত্তেজনা আছে, কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট পথের দিশা নেই। এ দেশের মানুষেরও রাজনীতিতে আগ্রহ আছে, রাজনীতি নিয়ে হতাশা, ক্ষোভ ও সমালোচনা আছে। কিন্তু চলমান রাজনীতি পরিবর্তনে তেমন কোনো ভূমিকা নেই। সংসদীয় রাজনীতিতে পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন করার বিধি আছে। সেই ভোটে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের দেশে সেই ভোটাধিকার প্রয়োগেরও নিশ্চিত ব্যবস্থা নেই। তারপরও দেশের মানুষের রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ-উত্তেজনার কোনো শেষ নেই।

জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদেরা নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে মগ্ন থাকেন। বিভিন্ন গুরুতর জাতীয় সমস্যার সমাধান নিয়েও তাঁদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। স্থানীয় সমস্যা নিয়েও তাঁরা মাথা ঘামান না। এদিকে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের জাতীয় রাজনীতিতে তেমন কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের হাল অনেকটা ফুটবলের মতো। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে যতই নৃত্য করুক না কেন, আসল ফুটবল প্রতিযোগিতার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারেন না।

কেন এমন হাল? রাজনীতি এমনিতেই খুব জটিল-কুটিল জিনিস। শাসনক্ষমতা দখলের রাজনীতি রূঢ় বাস্তবতা দিয়ে ঘেরা। সেই রাজনীতির চর্চায় খুব কষ্ট, ঝুঁকিও বড় বেশি, মারধর খাওয়ার আশঙ্কা প্রভূত, তাতে গড় রাজনীতিবিদের অনীহা। আসল রাজনীতি, বড় রাজনীতির ময়দানে যোগ্য নেতার ঘোর অনটন। অর্থনীতির ভাষায় বললে, এক্সেস ডিমান্ড। কিন্তু অন্য দিকে, রাজনীতিচর্চার রোমাঞ্চ আমরা অর্জন করতে চাই ক্ষুদ্রতর নানা পরিসরে। সেই সব পরিসরেই যত রাজনীতিবিদের ভিড়। এক্সেস সাপ্লাই।

পাড়ার মিলাদ, পূজা, বিয়ে, স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় কমিটি, কোনো সংগঠনের নিয়ামক বোর্ড, ক্লাবের, স্কুলের পরিচালনা কমিটি, ব্যবসায়ীদের সংগঠন, জোট, ছোট ছোট বিভিন্ন ধরনের সংগঠন—সব জায়গায় রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির বাড়বাড়ন্ত দেখে তাজ্জব হতে হয়। সব জায়গায় শাসক দল-বিরোধী দলের সমারোহ, জটিল-কুটিল পদ্ধতি প্রক্রিয়ার সাহায্যে অমুককে ল্যাং মেরে তমুক গোষ্ঠীকে বিপাকে ফেলে, অ্যাজেন্ডার ১০ নম্বর প্রস্তাবকে হিমঘরে পাঠিয়ে মাসল ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াই আমরা।

নিজস্ব প্রভাববলয় বাড়াতে উপদল গড়ি, মস্তান-উচ্ছৃঙ্খলদের প্রশ্রয় দিই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, টুপাইস কামানোর যাবতীয় মওকা খুঁজি, এর বাইরে রাজনীতির অন্য কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই। ফর্মুলাটা একই: ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। দাপট দেখানো।

সংগঠনের, প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে একবার ঢুকে পড়লে আমিই রাজা, আমিই ‘রাষ্ট্রপতি’, আমিই ‘প্রধানমন্ত্রী’। আমাদের দেশে বর্তমানে বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠীও রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জুড়ে দেন। রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে কারও কোনো পরিচিতি নেই। কিছু লোক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক হিসেবে মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। এই নিয়ন্ত্রক সংসদের সভ্যরা রাজা-উজির গড়বেন ও মারবেন, এটাই নিয়ম। আবার, ওই এক সমস্যা—রাজনীতি করতেই হবে। উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো, কোথাও না কোথাও সিংহাসন পাবেই।

যত ছোট প্রতিষ্ঠান, তত বড় লাফঝাঁপ। প্রতিষ্ঠানকে আঁকড়ে ধরে একেবারে ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্র্যাকটিস করা। কত কত ‘রাষ্ট্রপতি’ আর ‘প্রধানমন্ত্রী’, কত কত বিরোধী ‘নেতা-নেত্রী’ যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

যে বিপ্লব, আহা, বাইরে করা গেল না, বেচারা প্রতিষ্ঠানটিকেই তার ঠেলা সামলাতে হয়। আমরা বিভিন্ন কাগজে ‘আমরা-ওরা’ নিয়ে প্রচুর খবর পড়েছি। সেই ‘আমরা-ওরা’ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে রয়েছে। আপনি বাজার অর্থনীতির ভক্ত তো আমি সমাজতান্ত্রিক ধারার অর্থনীতি। আপনি লাল, আমি গোলাপি। আমি ঘোরতর আস্তিক, ধর্মঅন্তপ্রাণ, আপনি নাস্তিক। নিজেদের সব চারিত্রিক সম্পত্তি নিয়ে বসলাম বোর্ডের বা কাউন্সিলের মিটিংয়ে। সংগঠন করা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, সত্যি কথা।

কিন্তু আমি জানি, অনেকে শুধু সংগঠনই করেছেন বা এখনো করছেন, কাজ করেন না। রাজনীতি করে প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে ঘায়েল করা যায় অফিস, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত কাজের চেয়ে তা অনেক বেশি রোমাঞ্চকর। মাইনে নিয়ে শুধু রাজনীতি বা দলবাজি করেন এমন লোকও আমাদের দেশে প্রচুর আছে। তাঁকে ঘাঁটায় কার সাধ্যি। সবাই নিশ্চয়ই এমন নয়। অনেকেই আছেন, যাঁরা কখনো কোনো দিন কোথাও রাজনীতির সাহায্যে ক্ষমতাবান হতে চাননি। তাঁরাও এক অর্থে রাজনীতির বাইরে নন, কারণ আমাদের ব্যবহারিক জীবনে রাজনীতিকে এড়ানো শক্ত।

রাজনীতিচর্চার একটি বৌদ্ধিক এবং মানসিক দিক আছে, আর অন্য দিকে রয়েছে রাজনীতির কায়িক চেহারা, যেখানে ‘দাপুটে’ নেতার রমরমা। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে তথাকথিত ভদ্রলোক রাজনীতিবিদেরা শুধু নিজেদের সামাজিক পরিসরে ক্ষমতা দখলের খেলায় মেতে ওঠেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির বাইরে যে আখড়া, সেখানে ভিড় বাড়তে থাকে। রাজনীতিচর্চা হয়ে দাঁড়ায় মুদ্রাদোষের মতো। না করে থাকতে পারেন না। কেউ বলতে পারেন, প্রত্যক্ষ রাজনীতি মানেও তো দুর্নীতি। তার জন্যই তো যত সমস্যা।

কিন্তু এখানে সেটা প্রশ্ন নয়। পাড়ার ক্লাবকে কবজা না করে বা নিজেরই সহকর্মীকে বিভাগ থেকে না তাড়িয়ে, যদি সেই কূটবুদ্ধিসহকারে বৃহত্তর রাজনীতি করতেন, ভালো হতো না কি? ক্ষুদ্র পরিসরে পরোক্ষ রাজনীতির কোনো সুফল নেই, এমন কথাও বলছি না। হাজার হোক, রাজনীতির সাহায্যেই তো অশুভ শক্তিকে ঠেকানো যায়, অন্তত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সেটাই শিক্ষা। কিন্তু অত্যধিক রাজনীতির সমস্যা বিস্তর। যেমন নামীদামি অধ্যাপকের পরিচয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম হওয়া উচিত। সেই নাম ও দাম তাঁর কাজের প্রতিফলনে হবে, এটাই বাঞ্ছনীয়; কে সিনেট-সিন্ডিকেট-কোর্ট-কাছারির সদস্য হবেন, তা নিয়ে নয়। এ কথাটাই আমরা ভুলতে বসেছি।

পরিশেষে একটা সর্বগ্রাসী সর্বব্যাপ্ত রাজনীতির কথা না বলে পারছি না। ‘আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি’র রাজনীতি যেখানে কয়েক জন বলে, আর সবাই চুপ করে থাকে। অশান্তি নেই, প্রতিবাদ নেই, মিছিল নেই। যেন স্বেচ্ছায় স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছে সবাই কোনো এক অমোঘ, নিরঙ্কুশ, সদা সত্য রাজনৈতিক দর্শনের তাড়নায়। বিতর্ক নেই, তাই সংঘাতও নেই। দিনের পর দিন হাড়-হিম-করা শৃঙ্খলে আবদ্ধ সে ব্যবস্থা, যেখানে কাতারে কাতারে যোগ্য পদপ্রার্থীরা বঞ্চিত বা বিতাড়িত। শান্ত রাজনীতিই সর্বদা কাম্য, এমনটা হয়তো নয়।

রাজনীতির অভিমুখ পাল্টানো দরকার। একই কথা, একই কাজ সমাজে গভীর বিভাজনরেখা তৈরি করে। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নকে উৎসাহ জোগায়। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সমালোচনা চলা উচিত।

ক্ষমতাসীনেরা যদি পরিবর্তিত না হয়, বিরোধী দলও যদি তাদের নীতি ও কৌশল পরিবর্তন না করে, তাহলে আমাদের রাজনীতিতে নতুন পথের সন্ধান পাওয়া কঠিন। শুধু অনুশোচনা, খেদোক্তি আর কপাল চাপড়ানো ছাড়া আমাদের অন্য কোনো ভবিষ্যৎ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তা বিদেশিদের কাছে রাজনীতিবিদেরা যতই ধরনা দিক। বিদেশিরা বড়জোর খেলার কৌশল বদলাতে ভূমিকা পালন করতে পারে, কিন্তু তাতে ফল বদলাবে বলে মনে হয় না!

লেখক:গবেষক ও কলামিস্ট



Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button