
অন্যের থিসিস পেপার চুরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পিএইচডি ডিগ্রি হাতিয়ে নেওয়া এখন পুরনো খবর। থিসিস পেপার চুরি তো নৈতিকতাবিবর্জিত অপরাধ, কিন্তু এখন শিক্ষকরা নানা ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারিতেও নিজেদের কলুষিত করছেন। সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষকরা এখন নির্ধারিত ছুটি শেষে কাজে যোগ না দিয়েও বেতন-ভাতা তুলে নিচ্ছেন। গবেষণার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সুবিধা ভোগ করলেও তাদের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে বাড়ি ভাড়া কাটা হচ্ছে না। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি ভাতা দেওয়া হচ্ছে তাদের। তবে শিক্ষকরা যতটা না অবৈধ সুবিধা নিচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি অনিয়ম করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ। ভবন নির্মাণে অনিয়ম, ভর্তি পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ নানাভাবে লুটপাট চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। নানা অনিয়মের মাধ্যমে দুই বছরে রাষ্ট্রের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সরকারি ২৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বাংলাদেশের মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর লুটপাটের এ চিত্র পাওয়া গেছে। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয় নিরীক্ষা করেছে তারা।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন প্রোগ্রামে অননুমোদিতভাবে শিক্ষা ছুটিতে বিদেশে অবস্থান করছেন। এসব শিক্ষকের অনেকেই শিক্ষাছুটি শেষে কাজে যোগ দেননি। তবে তাদের বেতন-ভাতা দিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। শিক্ষকরা ছুটি শেষে কাজে যোগদান না করায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বসবাস করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন থেকে নির্ধারিত হারে বাড়ি ভাড়া কেটে রাখেনি। এতে করে সরকারের ২৫ কোটি ৯০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সিন্ডিকেট কিংবা অর্থ কমিটি কিংবা রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাড়ি ভাড়া কাটা হয়। নিরীক্ষায় নির্ধারিত বাড়ি ভাড়ার অর্থ আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিভাগ, অনুষদ, ডিন অফিস ও রিসার্চ সেন্টারের বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া নিজস্ব আয়সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে না দেখানোয় ৩৭ কোটি ১৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ আয় বাজেটে প্রদর্শন না করা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০১৯ সালের নির্দেশনার লঙ্ঘন।
নানা অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হাফিজা খাতুন ফোনে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
২০২১-২২ অর্থবছরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাঁচটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উন্নয়ন প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত না দিয়ে নিজেদের ব্যাংক হিসাবে রেখে দিয়েছে। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, অর্থবছর শেষে উন্নয়ন ব্যয়ের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। কিন্তু ওই পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয় তা জমা না দেওয়ায় সরকারের ১৬২ কোটি ৪৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদালয় ২০২১-২২ অর্থবছরে স্নাতক (সম্মান) প্রথমবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা থেকে ১৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা আয় করলেও তা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাবে দেখায়নি। এমনকি ওই আয় এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র নিরীক্ষায় উপস্থাপন করতে বললেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিরীক্ষা দলকে কোনো জবাব বা সহযোগিতা দেয়নি। এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এটি খুবই বিব্রতকর ও অগ্রহণযোগ্য। তবে আমি অবাক হইনি। কারণ কয়েক বছর আগে আমরাও দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে জরিপ চালিয়েছিলাম। সেখানেও এমন অনেক অনিয়ম পেয়েছিলাম। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠগুলোতে এমন অনিয়ম অনৈতিক ও দুঃখজনক।’
তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের সরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের অনৈতিক চর্চা চলছে। শিক্ষকদের একাংশের যোগসাজশে তা হচ্ছে, যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। সরকারি প্রতিষ্ঠান সিএজির নিরীক্ষাটি প্রশংসনীয়। এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে আমরা আশা করছি।’
নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ও গবেষণার চেয়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নজর অর্থের দিকে বেশি। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকল্পের টাকা যথেচ্ছ লুটপাট কিংবা শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি নিয়েও অনিয়মে পিছপা হননি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তাব্যক্তিরা।
সিএজির প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গাড়ি কিনতে ২০২২ সালের মে মাসে ইউজিসি ৮৭ লাখ টাকা ও তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) সামগ্রী কেনার জন্য ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু গাড়ি ও আইসিটি সামগ্রী না কিনে অন্য একটি ব্যাংক হিসাবে এ ১ কোটি ৭ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে। শিক্ষকদের প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ইন্টারনেট ভাতা হিসেবে ৫৬৪ জন শিক্ষককে মাসে ১ হাজার টাকা এবং ৩২৪ জন কর্মকর্তাকে ৫০০ টাকা করে মোট ৮৭ লাখ ১২ হাজার টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এভাবে বিল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নিরীক্ষকদের প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিল দেওয়া হয়েছে। নিরীক্ষকরা বলছেন, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে শিক্ষকদের ইন্টারনেট ভাতা দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই।
একই বিশ্ববিদ্যালয় কাল্পনিক বিভিন্ন কোটেশন দেখিয়ে এক ঠিকাদারকে ৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করেছে। একই ব্যক্তি কাল্পনিক কোটেশন কাগজ তৈরি করে বিল উত্তোলন করেছেন। নিরীক্ষকরা জবাব চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছেন, ‘কোটেশন জমাদানকারীর হাতের লেখা যাচাইয়ের বিষয়টি ভুলবশত নজরে আসেনি।’
বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিল পরিশোধ করা হয়েছে কিন্তু তার কোনো ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। এ ভ্যাটের পরিমাণ ৫৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা। তবে নিরীক্ষা দলের নজরে আসায় বিশ্ববিদ্যালয় এ অর্থ জমা দেওয়ার কথা জানিয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দিবস কেন্দ্র করে হলগুলোতে উন্নতমানের খাবার ও আলোকসজ্জার নাম করে ৮৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকার বেশি বিল পরিশোধ করেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিলের সমর্থনে কোনো ভাউচার নেই। বিল ভাউচার না থাকার কোনো স্পষ্ট জবাবও দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল আলমের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার রাশেদা আখতার মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমার জানার কথা নয়। এ বিষয়ে কোষাধ্যক্ষ ও কম্পট্রোলার বলতে পারবেন।’ কম্পট্রোলার মো. মোসানুল কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সিএজি তাদের মতো অবজারভেশন দিয়েছে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সপক্ষে জবাব দিচ্ছি। তবে এটুকু বলতে পারি, আমরা বিধিসম্মতভাবে কাজ করি।’
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি করে আয় হয়েছে ৩ কোটি ১৮ লাখ ২২ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা করেনি কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এ আয়ের ৬০ শতাংশ টাকা বিভিন্ন অনুষদে ব্যয় করা হয়েছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সময়কালে গবেষণায় অনুদান বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৫০ হাজার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো গবেষণা না করে বিভিন্ন মালামাল কিনেছে। মালামাল কেনার জন্য ৬৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা খরচ করেছে। কিন্তু বিধি অনুযায়ী যে উদ্দেশ্যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, সে উদ্দেশ্যেই খরচ করার নিয়ম রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরীক্ষকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছে, গবেষণা কাজের উদ্দেশ্যেই এসব মালামাল কেনা হয়েছে। নিরীক্ষা জবাবে বলা হয়েছে, গবেষণা অনুদানের বরাদ্দ শুধু গবেষণার জন্যই দেওয়া হয়। মালামাল কেনার সুযোগ নেই।
ইউজিসি তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সেবার নামে অনিয়মিতভাবে ৯২ লাখ ৭২ হাজার টাকা কেটে রেখেছে। এ অর্থ কী করা হয়েছে নিরীক্ষকরা জানতে চাইলে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ই বলেছে, সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে তথ্য-প্রমাণ নিয়ে তারা জানাবেন। কিন্তু নিরীক্ষক দল জবাবে বলেছে, কোনো প্রকার আইনি ভিত্তি ছাড়াই ইউজিসিকে অর্থ দেওয়া হয়েছে।
হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন ছাড়াই ১ কোটি টাকায় পাজেরো জিপ কেনা হয়েছে। অডিট নিষ্পত্তির জন্য জবাব চাইলে নিরীক্ষকদের এ বিষয়ে কোনো জবাব দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা ২০২১-২২ অর্থবছরে ‘অবকাঠামো ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম সম্প্রসারণ’ প্রকল্পে মন্ত্রিসভার কোনো ধরনের দরপত্র প্রস্তাব অনুমোদন ছাড়াই বৈজ্ঞানিক ল্যাব যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ৫৮ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসিসি রাস্তা নির্মাণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবে প্রতি মিটার রাস্তার জন্য অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু তারা অনুমোদিত ব্যয় উপেক্ষা করে প্রতি মিটারে খরচ করেছে ১০ হাজার ৬২১ টাকা। অর্থাৎ প্রকল্প প্রস্তাবে দেওয়া বাজেটের চেয়ে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ৩ কোটি টাকার বেশি।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই প্রকল্পের বিপরীতে অনিয়মের ফিরিস্তি আরও বেশি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ প্রকল্পে বাজেট ছাড়াই বিভিন্ন খাত দেখিয়ে ৩৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। আরেকটি আরসিসি রাস্তার নামে দরবহির্ভূত আইটেমের বিপরীতে খরচ করা হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আরও ভয়াবহ। সরকারের কোনো অনুমোদন এবং প্রকল্প প্রস্তাব ছাড়াই ১৬০ কোটি টাকার পূর্ত কাজ করেছে তারা। এ বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ক্যাম্পাসে দুটি ভবন বানানোর জন্য মেসার্স মজিদ কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে ১৬০ কোটি টাকার চুক্তি করে। পরিকল্পনা কমিশনের বিধি অনুযায়ী, ঘটনাত্তোর কোনো কাজের অনুমোদন পরিকল্পনা কমিশন দেয় না। তাছাড়া অর্থ বিভাগের মনিটরিং সেল থেকেও কোনো ছাড়পত্র নেয়নি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কর্তৃপক্ষ কোনো অডিটেরও জবাব দেয়নি।
এ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন খাতে দেনা দেখিয়ে ৩০ কোটি ৩১ লাখ টাকা খরচ করেছে। কিন্তু এ অর্থ কত বছর ধরে, কেন, কীভাবে বকেয়া পাওনা হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি প্রকল্পে একই ঠিকাদার মজিদ কনস্ট্রাকশনকে কয়েক ধাপে ১০১ কোটি ৪৯ লাখ টাকার বিল দিয়ে অনিয়ম করা হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে কোনো প্রকল্প হলে সে ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাগে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কোনো নিয়মের ধার ধারেননি। নিরীক্ষকরা জবাব চাইলে, বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজের জন্য কোনো জবাব দেয়নি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের মধ্যে আরও রয়েছে পছন্দের ঠিকাদার নাভানা ও মিলিনিয়াম সার্ভিস সেন্টারকে কোনো কোটেশন ছাড়াই ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে। ক্রয়সীমার চেয়ে বেশি দরে তাদের কাছ থেকে সেবা নেওয়া হয়েছে। এ অডিটেরও তারা কোনো জবাব দেয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির কারিগরি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো নিয়মের বালাই না করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে ডিপোজিট ওয়ার্ক হিসেবে ৮০ কোটি টাকা দিয়েছে।
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) আলোচিত এই দুই অর্থবছরে রাজস্ব তহবিল থেকে অনিয়মিতভাবে ১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা অন্য তহবিলে স্থানান্তর করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জবাবে বলেছে, প্রমাণ সংগ্রহ করে তারা জবাব দেবে। নিরীক্ষক দলের দাবি, এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
নির্ধারিত চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ইসলামী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে সেশন বেনিফিটের নামে অতিরিক্ত সময়ে চাকরির সুযোগ নিয়েছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষতি হয়েছে ৪ কোটি ২৮ লাখ টাকার বেশি।
অর্থ বিভাগের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অনুবিভাগের আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ ২০১৫ সালের স্মারক অনুযায়ী, কোনো ক্ষেত্রেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় না করা এবং বাজেটে বিভিন্ন কোডের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যেই প্রকৃত ব্যয় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ওই নির্দেশনা না মেনে দুই বছরে ৩৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। এর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদালয় ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ করা বাজেটের অতিরিক্ত ৩১ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। আর ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা। একই সময়ে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাদ্দকৃত বাজেটের অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ দর্শানোর নোটিসের কোনো জবাব দেয়নি পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ভবিষ্যতে বরাদ্দকৃত বাজেটের মধ্যে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ কঠোরভাবে পরিপালনের কথা জানিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আর অতিরিক্ত ব্যয় করলেও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাজেটে বরাদ্দপত্রে উল্লিখিত কোডের বিপরীতে মূল খাতের বরাদ্দের মধ্যে ব্যয় সীমাবদ্ধ রয়েছে।
এসব অনিয়মিত ব্যয়ের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে সিএজির অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে মূল পদের বাইরে বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে (প্রক্টর/প্রভোস্ট/চেয়ারম্যান/তত্ত্বাবধায়ক/ছাত্র উপদেষ্টা প্রভৃতি) অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব পদে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত দায়িত্বভাতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী, মূল বেতনের ১০ শতাংশ অথবা দেড় হাজার টাকার মধ্যে যেটা কম তা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় বেতন স্কেল লঙ্ঘন করে ১৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দায়িত্ব ভাতার অতিরিক্ত দেওয়ায় রাষ্ট্রের প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
অতিরিক্ত দায়িত্বভাতা প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদলয় কর্তৃপক্ষ নিরীক্ষা দলকে জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটির সুপারিশ ও সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা দেওয়া হয়েছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, দেড় হাজার টাকা দায়িত্ব ভাতা দিলে কোনো শিক্ষক নিজ পদের অতিরিক্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন না। তবে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের দেওয়া অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা জেনারেল ফান্ডে ফেরত নিয়ে এসেছে।
অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা প্রসঙ্গে নিরীক্ষা দল তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, বেতন ও ভাতা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ক্ষমতাপ্রাপ্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটি কিংবা সিন্ডিকেট নয়। দায়িত্ব ভাতা হিসেবে প্রদান করা অতিরিক্ত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা করার সুপারিশ জানিয়েছে সিএজি।
ইউজিসির অনুমোদন না থাকার পরও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় বিধিবহির্ভূতভাবে চুক্তিভিত্তিক জনবল নিয়োগের মাধ্যমে ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছে। এসব নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করেছে নিরীক্ষা দল।
২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আওতাধীন ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ১৮ কোটি টাকা অগ্রিম হিসেবে দিলেও নিরীক্ষাকাল পর্যন্ত তা সমন্বয় করেনি।